ঢাকা, রবিবার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পাকিস্তানকে গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে 

তাপস হালদার

প্রকাশিত : ১৫:৪৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকেই বাঙালি জাতির উপর শুরু হয় ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যা। চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন নির্মম গণহত্যা খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েও পাকিস্তান বসে থাকেনি। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে বিভিন্ন দেশে চালিয়ে যায় কূটনৈতিক তৎপরতা। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মলনে যোগদানের শর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। তারপর থেকে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এখনও দুইটি দেশের মধ্যে স্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় কখনো অম্ল,কখনো মধুর সম্পর্ক এভাবেই চলে আসছে।

একাত্তরের গণহত্যা ও বর্বরতার জন্য পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইবে, এই দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিটি সরকারই ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এক প্রকার উঁড়িয়ে দিয়েছে। ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফর কালে একবার `দুঃখ` প্রকাশ করেছিলেন। সেই দুঃখ প্রকাশকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো জনগণ খুশি হতে না পারলেও খুশি হয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দুই সরকার প্রধানের রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় মোশাররফকে ধন্যবাদ জানিয়ে  খালেদা জিয়া বলেন, ‘একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য এমন খোলামেলা বক্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই বক্তব্য, কোনো সন্দেহ নেই, পুরনো ক্ষত মিটাতে সাহায্য করবে। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই এবং ভাইয়ের মতো একযোগে কাজ করতে চাই।’ 

২০১১ সালে বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশে এসে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একাত্তরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তান সরকারের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছিলেন। তিনিও ক্ষমতায় এসে সেকথা বেমালুম ভুলে গেছেন। ২০১২ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার ঢাকায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইসলামাবাদে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে। তখনও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি উত্থাপন হলে, তিনি ক্ষমা চাইতে রাজি হন নি। তিনি বলেছিলেন, দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেছনের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ক্ষমাপ্রার্থণা না করায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে সময় পাকিস্তানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা হয়।

বাংলাদেশ যখন একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর, আল-শামসদের বিচার শুরু হয়, তখন চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দেয় পাকিস্তান। ২০১৩ সালে সরকার যখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করে, তখন পাকিস্তান সরকার এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় নিন্দা জানায় এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আহমেদ পরিষদে বলেন, মর্মান্তিক ওই ঘটনায় পুরো পাকিস্তান গভীরভাবে শোকাহত। তবে অবাক করা বিষয় হলো পাকিস্তান জামায়াতের সংসদ সদস্য শের আকবর খান নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলে তাতে সমর্থন জানায় দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ, বিরোধী দল মুসলীম লীগ, আওয়ামী মুসলীম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) ও জমিয়তে উলামা ইসলাম। এদিকে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। আর ২০১৬ সালে আরেক যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পরও বিবৃতি দেয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ ফাঁসির ঘটনায় পাকিস্তান ‘গভীরভাবে শোকাহত' বলে উল্লেখ করা হয়৷ বলা হয়, তার একমাত্র অপরাধ ছিল তিনি (১৯৭১ সালে) পাকিস্তানের সংবিধান এবং আইন সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশও কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানকে নাক না গলানোর বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়। যার কারণে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।

পৃথিবীর অনেক দেশই দেরিতে হলেও তাদের পূর্বসূরিদের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। ২০১০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের কাছে অধিগ্রহণকারী আমেরিকানদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে এক লিখিত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড তাদের দেশের আদিবাসীদের প্রতি অবিচারের জন্য যথাক্রমে ২০০৮ সালে ও ২০১৭ সালে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে। এমনকি গুয়াতেমালায় সামরিক সরকারের মানবিক অপরাধ সত্ত্বেও তাদের প্রতি সমর্থন জানানোয় সে দেশের আদিবাসীদের কাছে আমেরিকার পক্ষে ক্ষমা চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন। জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনী, সেজন্য এখনও দেশটির সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বিভিন্ন দেশের কাছে সুযোগ পেলেই ক্ষমা চান৷ নাৎসি বাহিনীকে নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে আবার যাতে এরা মাথাচাড়া দিতে না পারে, সে ব্যবস্থাও নিয়েছে সেদেশের সরকার৷

মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে। শুধু দেশের মধ্যেই দাবি সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্ব জুড়েই বাঙালিদের মধ্যে গণজাগরণ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী প্রবাসীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ’ পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে বিশ্বের ৫০টি দেশের পাকিস্তানি দূতাবাসের মাধ্যমে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে স্মারকলিপি দিয়েছে।

পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহলও এ দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত  হোসেন হাক্কানি বলেছেন,‘আজ পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। আমি মনে করি, ১৯৭১ সালে চালানো ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর সেজন্য পাকিস্তানি জনগণের উচিত তাদের সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।’ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একজন তরুণ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, সাবেক জেনারেল গোলাম মুস্তাফা এ বিষয়ে বলেন, ‘দোষ আমাদের সবারই ছিল। আমি নিজেকেও ততখানি অপরাধী মনে করি অন্যরা যেমন ভাবে। তখন তরুণ সেনা অফিসার ছিলাম। যা বলা হয়েছিল তাই করেছি। কিন্তু এতবড় অপরাধবোধ মেনে নিয়ে চলাটা ভীষণ কষ্টের।’ 

পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম যাদেরকে এতদিন মিথ্যা ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব হিসেবে বোঝানো হয়েছিলো, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তারা সঠিক ঘটনা জানতে পারছে। যার কারণে গণহত্যার প্রকৃত অবস্থা জেনে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানাচ্ছে সেদেশের তরুণ প্রজন্মও।

পাকিস্তানকে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে তাদের পূর্বসূরিদের অতীত কৃতকর্মের জন্য বাংলাদেশের জনগনের কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয়ে যায় না, এটা তাদেরকে বুঝতে হবে। দুঃখ প্রকাশ কিংবা অতীত ভুলে যাওয়া- এসব বলে দায় এড়ানো যাবে না। দুঃখ প্রকাশ আর ক্ষমা চাওয়া তো এক কথা নয়। দুঃখ প্রকাশের মধ্যে গণহত্যার জন্য দায় স্বীকারের কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু কোনো অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হলে আগে তাদেরকে সেই অপরাধের দায় স্বীকার করতে হয়। পাকিস্তানকেও অবশ্যই গণহত্যার দায় স্বীকার করেই ক্ষমা চাইতে হবে। 

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

ইমেইল: haldertapas80@gmail.com 

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি